খতিয়ান/Ledger
মুনাফা অর্জনই যদি হয় একটি ব্যবসায়ের প্রধান উদ্দেশ্য তবে ব্যবসায়ের লেনদেন এবং সেগুলোর হিসাব-নিকাশ অবশ্যই সঠিক এবং নির্ভুলভাবে হিসাব রাখতে হবে। অন্যথায় গন্তব্যে পৌছানো সম্ভব নয়। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সংঘটিত লেনদেনসমুহ প্রাথমিকভাবে তারিখ অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করা হলেও কোনো কোনো হিসাব সংক্রান্ত লেনদেন বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকে তা থেকে ফলাফল বা আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। এজন্য কোনো নির্দিষ্ট হিসাব সংক্রান্ত যাবতীয় লেনদেন একত্রিত করা প্রয়োজন। এভাবে প্রস্তুতকৃত হিসাবসমূহ যে বইতে সংরক্ষণ করা হয় তাকে খতিয়ান বলে।
খতিয়ান কী?
ইংরেজি Ledge শব্দের অর্থ 'তাক'। তাক বা শেলফ যেমন বিভিন্ন প্রকার গৃ্হস্থালির জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখা হয়। তেমনই খতিয়ানও ব্যবসায়ের লেনদেনগুলোর শ্রেণীবিন্যাস করে আলাদাভাবে রাখা হয়। তাই অনেকে মনে করেন, Ledge শব্দ হতেই Ledger বা খতিয়ানের উৎপত্তি। অর্থাৎ,যে হিসাবের বইতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সমস্ত লেনদেনের হিসাব জাবেদা হতে স্থানান্তরিত করে শ্রেণীবিন্যাস পূর্বক পৃথক পৃথক শিরোনামে সংক্ষিপ্তকারে স্থায়ীভাবে লিপিবদ্ধ করা হয় তাকে খতিয়ান বলে।ব্যবস্যা প্রতিষ্ঠানে লেনদেন সংঘটিত হওয়ার পর দ্বৈতসত্তা বিশ্লেষণ করে ডেবিট ও ক্রেডিট নির্ণয় করে ধারাবাহিকভাবে জাবেদায় লিপিবদ্ধ করা হয়। এরপর জাবেদা হতে ঐ সমস্ত লেনদেনের হিসাব খতিয়ানে স্থায়ী ও পাকাপাকিভাবে লিখা হয়। তাই খতিয়ানকে পাকা বা হিসাবের স্থায়ী বই বলা হয়। জাবেদা বহিতে যে সমস্ত হিসাব লিখা থাকবে খতিয়ানে প্রত্যেকটি হিসাবের জন্য আলাদা আলাদা ঘর বা ছক টানতে হয়। জাবেদা থেকে খতিয়ানে হিসাবসমূহ বিন্যাস করে লেখার ফলে হিসাবের ফলাফল, প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা ও দেনা-পাওনার পরিমাণ জানা যায়। তাছাড়া, জাবেদায় লিখন ছাড়াও খতিয়ানে হিসাব রাখা যায় কিন্তু খতিয়ান ছাড়া হিসাবের উদ্দেশ্য অর্জন সম্ভব নয়। এ সমস্ত কারণে খতিয়ানকে প্রধান হিসাব বই তথা সকল হিসাব বইয়ের রাজা বলা হয়। অতএব, আর্থিক লেনদেনসমূহের সুষ্ঠু ফলাফল ও আর্থিক অবস্থা নিরুপনের জন্য লেনদেনগুলোর জাবেদা হতে স্থানান্তরিত করে শ্রেণীবিন্যাস পূর্বক স্বতন্ত্র শিরোনামে সংক্ষেপে যে হিসাবের বইতে স্থায়ীভাবে লিপিবদ্ধ করা হয় তাকে খতিয়ান বলে।
খতিয়ানের প্রয়োজনীয়তা ব্যবসায়ে কতটুকু? একটি ব্যবসায়ে খতিয়ান বহি রাখার ফলে একটি ব্যবসায়ী কি কি উপকারীতা পেতে পারে?
ব্যবসায়ে মালিক তার বিনিয়োগকৃত অর্থ কতটুকু কাজে লাগাতে পেরেছে এবং তার থেকে কি পরিমাণ আউটকাম পেয়েছে তা সে কখন জানতে পারবে, যখন তার ব্যবসায়ে যাবতীয় লেনদেনগুলো সুনির্দিষ্ট নিয়মে সাজিয়ে রাখবে এবং হিসাবকাল শেষে তা হিসাব করার মাধ্যমে। আধুনিক হিসাব পদ্ধতিতে খতিয়ানের প্রয়োজন অপরিসীম। কারণ, খতিয়ানে হিসাবরক্ষন ছাড়া হিসাবের মূল উদ্দেশ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। খতিয়ানে হিসাবসমূহকে আলাদা আলাদা ভাবে করা হয়। তাছাড়াও খতিয়ানে সংক্ষিপ্ত আকারে এবং শ্রেণীবদ্ধভাবে সাজিয়ে বিভিন্ন হিসাব স্থানান্তর করলে আর্থিক ফলাফল ও অন্যান্য তথ্য সহজেই জানা যেতে পারে।
এবার চলুন দেখে নেওয়া যাক খতিয়ান একটি ব্যবসায়ে কিরূপ প্রভাব ফেলে।
হিসাবকালশেষে প্রতিষ্ঠানের আয় বিবরণী প্রস্তুত করে আর্থিক ফলাফল নির্ণয়ের জন্য খতিয়ান অপরিহার্য।
প্রতিটি হিসাবের প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য খতিয়ান অপরিহার্য।
খতিয়ানে লিপিবদ্ধ ব্যক্তিবাচক হিসাব থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দেনা-পাওনার পরিমাণ জানা যায়।
খতিয়ানে হিসাবসমূহের উদ্বৃত্ত নিয়ে রেওয়ামিল (খতিয়ানের পরবর্তী ধাপ) প্রস্তুত করে গাণিতিক শুদ্ধতা যাচাই করা যায়।
খতিয়ানে যে হিসাবসমূহ লিপিবদ্ধ করা হয় তার সাথে অন্যান্য বছরের হিসাবের তুলনা করে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়।
খতিয়ানে প্রত্যেকটি হিসাবের আলাদা আলাদা শিরোনাম থাকবে। অর্থাৎ একটি হিসাবকে বেজ বা ভিত্তি ধরে অপরটির এন্ট্রি করতে হয় খতিয়আনে সাধারণত দু ধরনের ছক ব্যবহার করা হয়। যথাঃ T ছক ও চলমানজের ছক।
‘T’ ছক অনুযায়ী প্রতিটি খতিয়ান হিসাবের বাম পাশকে ডেবিট এবং ডান পাশকে ক্রেডিট বলা হয়। অর্থাৎ শর্টকাটে বুঝার উপায় হল, জাবেদায় দুটি হিসাবের মধ্যে যে হিসাবের জন্য খতিয়ান করা হবে,সেই হিসাবটিকে বেজ বা ভিত্তি হিসেবে ধরে তার অপর যে হিসাব থাকবে সেটি জাবেদায় যে পাশে থাকবে তার বিপরীত পাশে খতিয়ানভুক্ত হবে অর্থাৎ জাবেদায় ডেবিটে থাকলে খতিয়ানে ক্রেডিট, জাবেদায় ক্রেডিটে থাকলে খতিয়ানে ডেবিটের ঘরে বসবে। উদাহরণ এর সাহায্যে দেখা যাক - ব্যবসায়ের জন্য আসবাবপত্র ক্রয় ২০,০০০ টাকা।
এর জাবেদা – আসবাবপত্র হিসাব – ডেবিট
নগদান হিসাব – ক্রেডিট
উল্লেখিত জাবেদা থেকে আসবাবপত্র হিসাবের উদ্বৃত্ত বের করতে হলে, আসবাবপত্র হিসাবকে বেজ নিয়ে অপর হিসাব অর্থাৎ নগদান হিসাব যেহেতু জাবেদায় ক্রেডিট দিকে আছে,তাই মোট উদ্বৃত্ত বের করার সুবিধার্তে নিয়মানুযায়ী তা খতিয়ানে ডেবিট দিকে বসবে।
শ্রেণীবিভাগঃ
ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লেনদেনের সংখ্যা কম হয়।তাই একটি খতিয়ান বইতে সকল হিসাব লেখা সম্ভব হয়। কিন্তু বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠানে লেনদেনের সংখ্যা এত বেশি হয় যে একটি মাত্র খতিয়ানে সকল হিসাব সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় না। তাই কাজের সুবিধার্তে বিভক্তিকরণ প্রয়োজন হয়। খতিয়ানকে দু ভাগে ভাগ করা যায়।1.ব্যক্তিক/সহকারী খতিয়ান ( PERSONAL LEDGER):
ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে রক্ষিত হিসাবসমূহ যে খতিয়ানে লিপিবদ্ধ করা হয় তাকে ব্যক্তিক বা সহকারী খতিয়ান বলে। বাকীতে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠানের নামে এই খতিয়ান সংরক্ষণ করা হয়। ব্যক্তিক খতিয়ান আবার (ক) দেনাদারদের খতিয়ান(খ) পাওনাদারদের খতিয়ান
এ দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
(ক) দেনাদারদের খতিয়ান ( DEBITOR'S LEDGER):
যে সব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিকট বাকীতে পণ্য বিক্রয় করা হয় তাদের হিসাবসমূহ যে খতিয়ানে লিপিবদ্ধ করা হয় তাকেই দেনাদারদের খতিয়ান বলে। উদা-করিমের নিকট বাকীতে পণ্য বিক্রয় করা হল ৪০০০ টাকা।
(খ)পাওনাদারদের খতিয়ান ( CREDITOR'S LEDGER):
যে সমস্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে বাকিতে পণ্য ক্রয় করা হয় তাদের নামের হিসাবসমূহ যে খতিয়ানে লিপিবদ্ধ করা হয় তাকে পাওনাদারদের খতিয়ান বলে। উদা-রহিমের নিকট হতে বাকীতে পণ্য ক্রয় করা হল ৩০০০টাকা।
2.অব্যক্তিক বা সাধারণ খতিয়ান(IMPERSONAL OR GENERAL LEDGER):
ব্যক্তি সংক্রান্ত হিসাব ছাড়া ব্যবসায়ের সকল প্রকার সম্পত্তি ও নামিক হিসাবসমূহ যে খতিয়ানে সংরক্ষণ করা হয় তাকে অব্যক্তিক বা সাধারণ খতিয়ান বলে। এই সাধারণ খতিয়ানকেও দুই ভাগে ভাগ করা যায়।(ক)প্রাইভেট খতিয়ান
(খ)নামিক খতিয়ান।
(ক)প্রাইভেট খতিয়ান(PRIVATE LEDGER) :
যে খতিয়ানে ব্যবসায়ের সম্পত্তি,দায় ও মূলধন সংক্রান্ত হিসাবসমূহ লিপিবদ্ধ করা হয় তাকে প্রাইভেট খতিয়ান বলে। যেমনঃ মেশিন ক্রয় করা হল।
(খ)নামিক খতিয়ান( NOMINAL LEDGER):
যে খতিয়ানে ব্যবসায়ের সকল প্রকার আয়-ব্যয় ও লাভ-ক্ষতি সংক্রান্ত হিসাবসমূহে লিখা হয় তাকে নামিক খতিয়ান বলে। যেমনঃ বেতন, ভাড়া ইত্যাদি।
খতিয়ান হিসাবের দুদিকের যোগফলের পার্থক্য নির্ণয় করাকে উদ্বৃত্ত নির্ণয় বা জের টানা বলে। যদি ডেবিট পাশের টাকার পরিমাণ ক্রেডিট পাশের টাকার পরিমাণের চেয়ে বেশি হয় তাহলে ডেবিট উদ্বৃত্ত এবং ক্রেডিট পাশের মোট পরিমাণ ডেবিট পাশের পরিমাণের চেয়ে বেশি হলে ক্রেডিট উদ্বৃত্ত বলে। অর্থাৎ দু পাশের টাকাকে সমতা আনার জন্য যে পাশে টাকার পরিমাণ কম সে পাশে আধুনিক নিয়মে উক্ত মাসের শেষ তারিখে ব্যলেন্স সিডি(carried down) লিখে যত টাকা কম, সেই পরিমাণ টাকা লিখতে হয় এরপর হিসাব বন্ধ অথবা ক্লোজ করে তার বিপরীত পাশে পরবর্তী মাসের ১ তারিখে সে পরিমাণ টাকা ব্যলেন্স বিডি(brought down) হিসেবে বসে।
উদাহরণের মাধ্যমে যদি দেখি-
মনে করি, 'T' ছকাকারে মার্চ মাসের নগদান হিসাবের ক্ষেত্রে মোট ডেবিটের পরিমাণ ২,৬১,০০০টাকা, ক্রেডিট দিকে ১,৮৮,০০০ টাকা। তাহলে উদ্বৃত্ত ( ২,৬১,০০০-১,৮৮,০০০)=৭৩,০০০টাকা। এ ক্ষেত্রে ডেবিটের পরিমাণ বেশি হওয়ায় মাসের শেষে ব্যলেন্স সিডি হিসেবে উদ্বৃত্ত ক্রেডিট দিকে ৭৩,০০০ বসিয়ে হিসাব ক্লোজ বা বন্ধ করতে হবে। সেই সাথে ঐ একই পরিমাণ টাকা ডেবিট দিকে পরবর্তী মাসের অর্থাৎ এপ্রিল এর ১ তারিখে ব্যলেন্স বিডি হিসেবে বসবে।
প্রিয় পাঠকগণ, আলোচনা আর বেশি দীর্ঘায়ীত করছি না। আলোচনায় খতিয়ান সম্পর্কিত কোনো কিছু বুঝতে না পারলে অবশ্যই নিচের কমেন্ট সেকশনে জানাবেন, চেষ্টা করব উত্তর দেওয়ার জন্য। ভুল-ত্রুটি গুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আজ এখানেই বিদায় নিচ্ছি। সকলের সুস্থতা ও সাফল্যমন্ডিত ভবিষ্যত কামনা করছি।
আসসালামু আলাইকুম।
মির্জা গোলাম ফাত্তাহ্
অর্থনীতি বিভাগ (স্নাতক ২য় বর্ষ)
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
No comments